বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ফেসবুকের জনপ্রিয়তা এখন আকাশচুম্বী। দেশে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০০৯ সালের মাত্র ৯৬ হাজার থেকে এখন এক কেটি আট লাখে পৌঁছেছে। নিজের মত প্রকাশ, নতুন-পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি অন্যান্য কাজেও ক্রমাগত এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি দপ্তরেও চালু হচ্ছে ফেসবুক পেজ। ফেসবুককে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে নতুন পেশার সুযোগ
ইংল্যান্ডপ্রবাসী নাতির ছবি দেখার জন্য প্রায় প্রতিদিনই একবার সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ফেসবুকে (www.facebook.com) লগ ইন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। এর বাইরে তিনি খুব একটা সময় ফেসবুকে দেন না।
তবে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার যতক্ষণ কম্পিউটারে কাজ করেন, ততক্ষণই তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট লগ-ইন করা থাকে। ‘আমার কাজের অনেকখানি ফেসবুকের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমার লেখালেখির কাজেও এটি আমাকে সহায়তা করে থাকে’, জানালেন মোস্তাফা জব্বার।
এই দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিরই অভিমত, আসক্তির পর্যায়ে না গেলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক মানুষকে কাছে আনে, যা এই কর্মব্যস্ত জীবনে সম্ভব নয়। তাঁদের মতোই দেশে বয়স্ক ব্যক্তিদের ফেসবুক ব্যবহারের মূল কারণ সামাজিক যোগাযোগই।
তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের তরুণপ্রজন্ম কেবল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এটিকে ব্যবহার করছে না। নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহারকারী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আনজিলা জেরিন ২০১১ সাল থেকে ফেসবুকে যুক্ত। সে জানায়, ফেসবুকে কেবল পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া যায় তা নয়,নতুন বন্ধুও তৈরি করা যায়। তবে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের এইচএসসি উত্তীর্ণ আশির ইবনে করিমের মতে, ‘বন্ধু নির্বাচনেও সতর্ক থাকার দরকার।’ বন্ধুত্বের বাইরে স্বাধীন মত প্রকাশ, সমমনাদের একত্র করা, নিজের পছন্দ-অপছন্দ অন্যকে জানানোর পাশাপাশি তাৎক্ষণিকভাবে সংব আদান-প্রদানেরও মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক।
দেশে ফেসবুকের বর্তমান অবস্থা
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ফেসবুকের জনপ্রিয়তা এখন আকাশচুম্বী। দেশে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০০৯ সালের মাত্র ৯৬ হাজার থেকে এখন এক কেটি আট লাখে পৌঁছেছে। নিজের মত প্রকাশ, নতুন-পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি অন্যান্য কাজেও ক্রমাগত এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোবাইলে তৃতীয় প্রজন্মের সেবা চালু, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও গণমাধ্যমের ফেসবুকে উপস্থিতি এবং সন্ত্রাস দমন আইন,তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ২০১৩ (সংশোধিত) এর ৫৭ ধারা নিয়ে মূল গণমাধ্যমে আলাপ-আলোচনা সাধারণ মানুষকে ফেসবুকে আকৃষ্ট করছে। এ ছাড়া ক্রিকেট ও বিনোদন জগতের তারকারাও তাদের ফ্যানদের ফেসবুকে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়িয়েছে।
ফেসবুকে সরকারি দপ্তর
সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটিকে সরকার তথ্য ও সেবার কাজে ব্যবহার শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের কাছ থেকে জানা গেছে, ২০১২ সাল থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ফেসবুক পেজ/গ্রুপ তৈরি করা শুরু করে। বর্তমানে ১২০টির বেশি সরকারি দপ্তরের ফেসবুক পেজ/গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ১৬টি মন্ত্রণালয়, ২৭টি অধিদপ্তর ও ১৪টি উপজেলা। আগামী দিনে এর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানান প্রকল্পের কর্মকর্তা মানিক মাহমুদ।
ফেসবুকে বাণিজ্য, বাণিজ্যে ফেসবুক
২০১২ সালে ফেসবুকভিত্তিক একটি গ্রুপের ব্যবসাসংক্রান্ত একটি কর্মশালাতে যোগ দেন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম। কর্মশালা শেষে বন্ধুর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নেন এবং রাতেই ফেসবুকে আমার গেজেট নামে একটি পেজ খুলেন (https://www.facebook.com/Amargadget)। শুরু করেন ফেসবুকের মাধ্যমে গেজেট বিক্রি। বছর না ঘুরতেই এলিফ্যান্ট রোডে অফিস নেন। এখন সেখানে তাঁর একটি শোরুম হয়েছে আর চাকরি দিয়েছেন চারজন কর্মীর! সাইফুল জানালেন, ফেসবুক থেকে শুরু করে এখন তাঁর প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ ই-কমার্স সাইট হিসেবেও কাজ করছে।
ফেসবুক স্টোর হলো একটি ভাচুর্য়াল দোকান যা ফেসবুক পেজ থেকে পরিচালিত হয়। এটি ফেসবুক কমার্স হিসেবেও পরিচিত। সেখানে উদ্যোক্তারা তাঁদের পণ্য বা সেবার ছবি, মূল্য, গুণাগুণ ইত্যাদি প্রকাশ করে থাকেন। তাতে আরও থাকে কীভাবে সেই পণ্য বা সেবা পাওয়া যাবে তার বিবরণ। বিষয়টি ওয়েবসাইটকেন্দ্রিক ই-কমার্সের মতো। তবে, ওয়েবসাইট চালু করার জন্য যে কারিগরি জ্ঞান বা দক্ষতার প্রয়োজন, ফেসবুক পেজের জন্য তা দরকার নেই। সাধারণ একজন ব্যবহারকারীই এই ধরনের একটি পেজ চালু করতে পারেন। ফলে কেবল গেজেট নয় ফেসবুকে এখন বিক্রি হচ্ছে রাজশাহীর আম, নারায়ণগঞ্জের জামদানি, কুমিল্লার খদ্দর, বগুড়ার দই, নান্না মিয়ার বিরিয়ানি থেকে শুরু করে যন্ত্রাংশসহ নানান পণ্য। এমনকি অনেকে বিভিন্ন দোকান থেকে খাবার সংগ্রহ করে তা ভোক্তার বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। আর গ্রাহকেরা তাদের খুঁজে নিচ্ছে ফেসবুকে।
ই কমার্স থেকে এফ কমার্স
তবে বাংলাদেশে ফেসবুককে কেন্দ্ করে যে নতুন উদ্যোক্তা সংস্কৃতিটি ডানা মেলত করেছে তা হচ্ছে ফেসবুক বাণিজ্য, যেমনটি করেছেন সাইফুল ইসলাম। ফেসবুকে ব্যবসা শুরুর খরচ কম বলে নতুন উদ্যোক্তাদের অনেকেই এদিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করছেন উদ্যোক্তাদের মূলধন সরবরাহকারী (ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি) প্রতিষ্ঠান বিডিভেঞ্চার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত হোসেন। তবে ব্যবসা শুরুর খরচ কম হলেও অন্যান্য উদ্যোগের মতো এখানে টিকে থাকার জন্য ব্যবসার মূলনীতি তথা ভালো পণ্য ও সেবা, গ্রাহক সন্তুষ্টির দিকেই নজর দিতে হবে বলে তিনি নবীন উদ্যোক্তাদের স্মরণ করিয়ে দেন।
বাংলাদেশের অনলাইন বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘জি অ্যান্ড আর’-এরবিপণনপ্রধান মির্জা সালমান হোসেনের মতে নিছক আড্ডা কিংবা নেটওয়ার্কিংয়ের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে বাংলাদেশের ফেসবুক। তাঁর মতে, শুধু ফেসবুককে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এবং সক্রিয় আছে এমন ফেসবুক কমার্সভিত্তিক (এফ কমার্স) ব্যবসায়ী আছেন দেশে প্রায় তিন হাজারের বেশি। যাঁদের বর্তমান মাসিক আয় ৫০ হাজার থেকে শুরু করে তিন-চার লাখ টাকা।
তৈরি হচ্ছে নতুন পেশা
ফেসবুকের এই বিস্তারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন এমন প্রকৌশলীদের নতুন পেশা। ফেসবুকের জন্য গেম তৈরি করা, ব্যবসায়িক পেজে অনুসারীদের (ফেসবুকের ভাষায় ফ্যান) সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে দেওয়ার প্রোগ্রাম তৈরি করার কাজের বাজারও ক্রমাগত বাড়ছে।
অনেক প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানও তাদের পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য ফেসবুকে নিয়মিত প্রচারণা চালানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগের বিপণনকারীদের নিয়োগ দিচ্ছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান এই কাজের জন্য আলাদা লোক নিয়োগ দিচ্ছেন, অনেক বিজ্ঞাপনী সংস্থাও এখন এই ধরনের সেবা দিচ্ছে। ফেসবুক বিপণন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাগনিটো ডিজিটালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াদ হুসাইন প্রথম আলোকে জানান, খুব দ্রুতগতিতে ফেসবুক ব্যবহারকারী বাড়ায় ব্যবসায়িকভাবে অনেকেই এখন ফেসবুক নিয়ে ভাবছেন এবং গুরুত্ব দিচ্ছেন। এখন সব প্রতিষ্ঠানই ফেসবুকে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। দেশে ফেসবুককে কেন্দ্র করে বাড়ছে ব্যবসাও।
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি মোস্তাফা জাব্বার মনে করেন, ফেসবুকের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার এ ঘটনা দেশে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এই ব্যাপারে বেসিসের সভাপতি শামীম আহসান মনে করেন সম্ভাবনার ব্যাপারটিকে আরও এগিয়ে নিতে হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আরও সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। কেবল উদ্যোগ নেওয়া নয়,ফেসবুকের এই বিশাল ব্যবহারকারীর সংখ্যা নতুন উদ্যোক্তাদের একত্র হওয়ার ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মও তৈরি করতে সহায়তা করছে। নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করার জন্য তৈরি হওয়া এ রকম একটি গ্রুপ ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ (www.facebook.com/groups/uddokta) গ্রুপে এখন প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি সদস্য রয়েছেন। সদস্যরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ, মতবিনিময় এমনকি নতুন বিনিয়োগের বিষয়েও পরস্পরকে সহায়তা করে থাকেন। এই গ্রুপেরই একটি কর্মশালা সাইফুল ইসলামকে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়তে অনুপ্রাণিত করে। এই ফেসবুক বাণিজ্য এবং আত্মকর্মসংস্থানের জন্য নতুন প্রজন্মের পারস্পরিক যোগাযোগ দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরিতে একটি আবহ তৈরিতে অবদান রাখবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ভাবনা-দুর্ভাবনা
ফেসবুকের ব্যাপক প্রসারের ফলে একে নিয়ে নানা দুর্ভাবনারও সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের ব্যাপকভাবে ফেসবুক ব্যবহারের কারণে তাদের মূল কাজের বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা বেড়েছে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী মনে করেন, শিক্ষার্থীদের ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সংযত হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি শামীম আহসান বলেন, যদিও ফেসবুক উদ্যোক্তাদের স্বল্প খরচে বিপণন ও নেটওয়ার্কিংয়ের সুবিধা সৃষ্টি করেছে, তার পরও এটি ব্যবহারে সংযত থাকা দরকার।
ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকের কাছে সহজে মিথ্যা তথ্য বা ভুল তথ্য পৌঁছানো সহজ। তাই কেউ কেউ দূরভিসন্ধিমূলক কাজের জন্য ফেসবুককে ব্যবহার করতে পারেন। রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলার ব্যাপারে ফেসবুকের অপব্যবহারের দিকটিও অনেকে লক্ষ করেছেন। তবে, ফেসবুককে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার হতে পারেন মেয়েরা। এর মধ্য রয়েছে কোনো মেয়ের টেলিফোন নম্বর ছড়িয়ে দেওয়া, মেয়েদের প্রোফাইল থেকে ছবি নিয়ে তা বিভিন্ন আপত্তিকর পেজে প্রকাশ করা, কোনো মেয়ের অসম্মতিতে তার নামে অ্যাকাউন্ট (ফেক অ্যাকাউন্ট) তৈরি করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বিশিষ্ট মনোরোগ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামালের মতে একদল যুবক ফেসবুকে মেয়েদের নানাভাবে উক্ত্যক্ত করাসহ প্রতারণা করে থাকে। অনেক সময় এরা মেয়ে সেজে বন্ধুত্বের সূচনা করে এবং পরে স্বরূপে আত্মপ্রক করে। বিশ্বব্যাপী অনলাইনে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে পরিচালিত আন্তর্জাতিক প্রচারণা ‘টেইক ব্যাক দ্য টেক’-এর বাংলাদেশের সমন্বয়কারী সাজিয়া আফরিন জানালেন, সচেতনতা, সতর্কতা এবং সক্ষমতা বাড়িয়ে নার মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারে। তিনি আরও জানান, ব্যক্তি জীবনে বন্ধু নির্বাচনে যেমন সতর্ক থাকতে হয় ফেসবুকেও সেই চর্চাটি অব্যাহত রাখতে হবে। তার পরও কোনো ঘটনা ঘটে গেলে তার জন্য যথাযথ আইনের আশ্রয় নেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
Search This Blog
Monday, December 1, 2014
বাংলাদেশে Facebook
Labels:
bd-fb
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment